বাংলার ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনে সাফল্য পাওয়ার সুখবর দিয়েছে বাংলাদেশের দুই দল বিজ্ঞানী।
দুই দল বিজ্ঞানী আলাদাভাগে এই গবেষণা চালালেও সফল হওয়ার বিষয়টি তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন প্রায় একই সময়ে।
জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনোমে নিউক্লিওটাইডগুলো কীভাবে বিন্যস্ত আছে তার লিপিবদ্ধ করাকে বলে জিনোম সিকোয়েন্সিং। এই নকশার ওপরই নির্ভর করে ওই প্রাণি বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জাতীয় মাছ ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স জানা সম্ভব হওয়ায় এ মাছের সার্বিক জৈবিক কার্যক্রম সম্পর্কে এখন পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যাবে। আর সেই জ্ঞান ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণেও কাজে লাগানো যাবে।
বিশ্বের মোট ৭৫ শতাংশ ইলিশ আহরিত হয় বাংলাদেশে । দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩.৮৭ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়, যার বাজার মূল্য ১৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। আর জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১%।
গত বছর ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তার এক বছরের মাথায় জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের সুখবর দিলেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষক দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক সামছুল আলম।
এই গবেষণায় তার সঙ্গে ছিলেন পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বজলুর রহমান মোল্লা, বায়োটেকনোলজির অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক গোলাম কাদের খান।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতি কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের কাজের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন অধ্যাপক সামছুল আলম।
তিনি বলেন, এই গবেষণার ফলাফল তারা গতবছর ২৫ অগাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনে জাম দিয়েছেন। সেখান থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সের কোড নম্বরও তাদের দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দলটির ইলিশ গবেষণা শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। প্রথমে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার পূর্ণবয়স্ক ইলিশ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। জিনোম সিকোয়েন্স তৈরির কাজে সাফল্য ধরা দেয় দুই বছরের মাথায়।
অধ্যাপক সামছুল আলম বলেন, ইলিশের জিনোমে ৭৬ লাখ ৮০ হাজার নিউক্লিওটাইড রয়েছে, যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানা সম্ভব হওয়ায় এখন এ মাছের বিষয়ে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
“ইলিশ মাছের প্রজনন হয় বছরে দুই বার। এই দুই সময়ের ইলিশ জিনগতভাবে আলাদা কি না; পদ্মা ও মেঘনার ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কিনা; নির্দিষ্ট নদীতে জন্ম নেওয়া পোনা সাগরে যাওয়ার পর বড় হয়ে প্রজননের জন্য আবার একই নদীতে ফিরে আসে কিনা- এসব তথ্যও এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে জানা যাবে।”
ইলিশের গবেষণায় সাফল্য পাওয়া অন্য দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান। তবে এর মূল উদ্যোগটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিওটাইড রসায়ন বিভাগের প্রধান মং সানু মারমার।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী একেএম আবদুল বাতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম, প্রভাষক ফারহানা তাসনিম চৌধুরী, গবেষক অলি আহমেদ, অভিজিৎ দাস, তাসনিম এহসান, জুলিয়া নাসরিন ও রিফাত নেহলিন ছিলেন এ গবেষক দলে।
অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, ড. মং সানুর কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় তারা ইলিশ নিয়ে এ গবেষণা চালান। তবে তাদের পাওয়া ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স এখনও আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে পাঠানো হয়নি।
এই গবেষক দলটি গত বছর সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন নদীর মোহনা, সাগরসহ সাতটি স্থান থেকে ইলিশের ডিএনএ ও আরএনএ নমুনা সংগ্রহ করে। এরপর কয়েকটি ভাগে আলাদাভাবে ঢাকা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণার বিভিন্ন ধাপের কাজ চলে।
এর মধ্যে ড. মং সানু যুক্তরাষ্ট্রে বসে ডিএনএ বিন্যাসের কাজটি করেন। অস্ট্রেলিয়ায় হয় ডিএনএ অ্যাসেম্বলির কাজ। গবেষক দলের অন্যরা এখন ঢাকায় আরএনএ-এর তথ্য বিশ্লেষণের কাজ করছেন।
বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ।
কৃতিত্বের দাবি
দুই দল বিজ্ঞানীর এই সাফল্যের সুখবরের সঙ্গে কৃতিত্বের দাবি নিয়ে তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও এসেছে।
অধ্যাপক হাসিনা খান আর মং সানু মারমার দলের সাফল্যের খবর গত কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে আসছিল। এর মধ্যে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের গবেষকরা নিজেদের সাফল্যের কথা জানানোর পাশাপাশি গবেষকদের অন্য দলটির দিকে অভিযোগের আঙুলও তোলেন।
অধ্যাপক সামছুল আলম বলেন, তাদের গবেষণার কাজ এক বছর আগে শেষ হয়। সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে তারা ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস কনফারেন্স করে বিষয়টি বিশ্বকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দাওয়াত কার্ডও পাঠানো হয়।
“গত ৩ সেপ্টেম্বর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দাওয়াত কার্ড পাঠিয়েছি। আমাদের কার্ড দেখেই তড়িঘড়ি ক্রেডিট নেওয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যমকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নিউজ করিয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়।”
এ গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক বজলুর রহমান মোল্যা বলেন, “২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আমাদের গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। তারা এত কিছু জেনেও কীভাবে এ কাজটি করল তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। গুগল করলেই আমাদের রিসার্চ পাওয়া যাবে; কিন্তু তাদের কোনো কিছুই প্রাকাশিত হয়নি।”
কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, “আন্তর্জাতিক ফোরামে পাঠানো মানে পাবলিক ডেটাবেজে জমা দেওয়া, সেখানে জমা দিলে বাংলাদেশের যেটুকু প্রপার্টি রাইট এটা থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা সেগুলোও নাকচ হয়ে যায়, সে কারণে আমি জমা দিইনি। একবার পাবলিক ডেটাবেজে চলে গেলে এটার উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, সেখান থেকে তথ্য অন্য কেউ নিতে পারবে। সে কারণে আমি জমা দিইনি।”
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দাবির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “আমরা কাজ করেছি নিউক্লিয়াসের জিনোম নিয়ে। সেটেই আসল জিনোম। উনারা যেটা জমা দিয়েছেন সেটা মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোম। উনারা নিউক্লিয়াসের জিনোম নিয়ে কাজ করলেও সেটা জমা দেননি।
“উনারা ডিএনএর মধ্যে ইউনিট পেয়েছেন ৭৬৮ মিলিয়ন, আর আমরা পেয়েছি এক বিলিয়ন; প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বেশি। আমরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যাবহার করে জেনেছি, আমাদের জিনোম ৯৫ শতাংশ কমপ্লিট। এটা খুব ভালো তথ্য দিয়েছে।”
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পাঠানো কোনো দাওয়াত কার্ড পাননি বলেও দাবি করেন অধ্যাপক হাসিনা খান।
– বিডিনিউজ