গণমাধ্যম ডেস্ক: বছর ঘুরলেও শেষ হয়নি ১৫ অাগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আগে ঢাকার পান্থপথের ওলিও হোটেলে বিস্ফোরণের মামলার তদন্ত।
ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছে পান্থপথের ওই হোটেলে আশ্রয় নিয়ে জঙ্গিরা ১৫ অাগস্টের কর্মসূচিতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে পুলিশের দাবি।
তার আগে ১৪ অাগস্ট রাত থেকে অভিযানের মধ্যে ওলিও হোটেল ঘেরাও করেছিল পুলিশ; পরে সোয়াট নামে অভিযানে। এক পর্যায়ে সকালে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক জঙ্গি আত্মঘাতী হন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়।
ঘটনার পরদিন কলাবাগান থানার এসআই সৈয়দ ইমরুল সাহেদ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা করেন। নিহত সাইফুল ইসলামের ডিএনএ টেস্টও করে রাখে সিআইডি।
এরপর মামলার তদন্তে এই পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া যায় মামলার নথিপত্র ঘেঁটে; তবে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের জানান, গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ১৪।
গ্রেপ্তারের পর প্রায় প্রত্যেক আসামিকেই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এর মধ্যে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। তারা হলেন আবুল কাশেম ফকির ওরফে আবু, আবদুল্লাহ আইচান কবিরাজ ওরফে রফিক, তানভির ইয়াসিন করিম, সাদিয়া হোসেন, তাজরিন খানম শুভ ও নাজমুল হোসেন মামুন।
তবে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ১০ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এই মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন সাদিয়া হোসনা লাকী, মো. তাজুল ইসলাম ওরফে ছোটন ওরফে মোহাম্মদ ওরফে ফাহিম, আকরাম হোসেন খান নিলয়, তারেক মোহাম্মদ ওরফে আদনান, লুলু সরদার ওরফে সহিদ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু আবু তোরাব খান হাই কোর্ট থেকে এবং হুমায়রা জাকির নাবিলা ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পেয়ে মুক্ত রয়েছেন।
মামলাটি আগে তদন্ত করতেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এসআই প্রদীপ সরকার। এখন তদন্ত করছেন একই বিভাগের পরিদর্শক রাজু আহমেদ।
তদন্ত কর্মকর্তা রাজু আহমেদের কাছে তদন্তের অগ্রগতির কথা জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে চাননি।
তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারবেন আমাদের বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।”
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামের নাম বলেন তিনি। মঙ্গলবার নানাভাবে চেষ্টা করেও মনিরুলের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পান্থপথের এই হোটেল ওলিওতে অবস্থান নিয়ে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে হামলা পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা; পরে যা পুলিশের অভিযানে নস্যাৎ হয়ে যায়।
অভিযানের পর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরকে কেন্দ্র করে অাগস্টের মিছিলে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলা করবে এবং শত শত লোক মেরে ফেলবে- এ ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।”
ওই বিস্ফোরণে হোটেলে ওলিওর চতুর্থ তলার রাস্তা সংলগ্ন দেয়াল ও গ্রিল ভেঙে রাস্তার ওপর পড়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বোমাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে কোনো জনসভা বা সমাবেশে তা ফাটানো হলে বড় ধরনের ক্ষতি হত।
নিহত সাইফুল খুলনার বিএল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি এক সময় ইসলামী ছাত্রশিবিরে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য। তার বাবা আবুল খায়ের মোল্লা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর বায়তুল মাল (কোষাধ্যক্ষ) সম্পাদক ছিলেন বলেও তখন পুলিশ জানিয়েছিল।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, ওলিও হোটেলের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গত ৫ এপ্রিল রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হুমায়রা ওরফে নাবিলাকে।
এই নাবিলা নব্য জেএমবির নারী শাখার প্রধান বলে জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। কর্মকর্তারা বলেন, নাবিলা তার সংগঠনে ‘ব্যাট উইমেন’ নামে পরিচিত ছিলেন।
পুলিশ বলছে, ঢাকার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করার পর নাবিলা মালয়েশিয়ার লিংকন ইন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তার সঙ্গে নব্য জেএমবির তৎকালীন আমির আকরাম হোসেন নিলয়ের পরিচয় হয়। পরে তারা ঢাকায় ফিরে নব্য জেএমবির ‘সিস্টার উইং’ নামে একটি শাখা গঠন করেন।
নাবিলাকে গ্রেপ্তারের পাঁচ মাস আগে গত ১৯ নভেম্বর তার স্বামী তানভির ইয়াসিন করিমকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তানভির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওলিও হোটেলকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু ভবনে মামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা হিসেবে নিলয়ের নাম উল্লেখ করেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।
তানভিরের কাছে পুলিশ কর্মকর্তারা তথ্য পেয়েছেন যে নিলয় ও তার বোনের পরিকল্পনায় বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ওই হামলার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল।
তাজরিন গত বছরের ১৪ নভেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
নাবিলাকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়া যায়নি। তবে সাক্ষী হিসেবে তার এক খালাত ভাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে নথিপত্রে দেখা যায়।
নাবিলার জামিন পাওয়ার বিষয়ে তার আইনজীবী মানিক লাল ঘোষ বলেন, “যেহেতু তার একটি শিশু সন্তান রয়েছে, সেই বিবেচনায় আদালত জামিন দিয়েছে।”
আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র এখনও জমা না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন আসামি পক্ষের এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “এ সব স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত দ্রুতই হওয়া উচিৎ। তদন্তে কোনো কালক্ষেপণ করা ঠিক না। দ্রুত তদন্ত শেষে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিও জরুরি।”
ঢাকার পান্থপথে মঙ্গলবার হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট সদস্যদের অভিযানে সন্দেহভাজন এক জেএমবি সদস্য নিহত হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, নিলয়ের ব্যবহার করা দুটি মোবাইল ফোন, তার ই-মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্টগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা এফবিআইর বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষার জন্য গত ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা রাজু আহমেদ। তার আবেদন মঞ্জুরও হয়।
আসামি নিলয়, তাজরিন ও আবু তোরাবের আইনজীবী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “এফবিআইকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হলেও আমার জানা মতে সে কাজ আদৌ করা হয়নি।”
এই আইনজীবী বলেন, “নিলয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন এ মামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা নয়। যদিও তাদের কারও কারও ১৬৪ ধারা জবানবন্দি রয়েছে, যা পরে আমি আদালতে প্রত্যাহার চেয়েছি।”
ঢাকার মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফরিদ আহম্মেদ জানান, আগামী ২৮ অগাস্ট হাকিম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার দিন ধার্য রয়েছে; যদিও এর আগেও এমন দিন বেশ কয়েকবার ধার্য হলেও প্রতিবেদন না পেয়ে তা পিছিয়ে যায়।