২০ জন শ্রমিকের সহায়তায় ছয় ঘণ্টা ধরে সাড়ে চার ফুট গভীরে ফলশূন্য খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে মিরপুর-১০ নম্বরের সি-ব্লকের বাড়িতে কথিত ‘গুপ্তধন’ উদ্ধার অভিযান আপাতত স্থগিত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বলছে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে দুই থেকে চারদিনের মধ্যে আবারও অভিযান শুরু করা হবে। তবে নতুন অভিযানে ‘গুপ্তধন’ খুঁজতে গ্রাউন্ড রাডার অথবা ‘স্ক্যানারেই ভরসা রাখতে চান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া, এই ইস্যুতে বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একজনের বদলে সামগ্রিকভাবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের তাগিদ বোধ করছে প্রশাসন ও পুলিশ।
ওই বাড়ির মেঝের নিচে সত্যিই ‘গুপ্তধন’ আছে কিনা, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত কোনও তথ্য নেই। অন্যদিকে, মাটি খননের পরও কথিত ‘গুপ্তধন’ না পেয়ে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এছাড়া, কথিত গুপ্তধন সন্ধানে আরও কী কী পদ্ধতি-প্রক্রিয়া আছে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা চলছে।
ভূতত্ত্ব ও পরিবেশবিদরা বলছেন, যেসব জায়গা খোঁড়াখুঁড়ির অনুপযোগী অথবা ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। মিরপুরের ওই বাড়িতে প্রযুক্তি ব্যবহারের আগেই খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। আসলে গুপ্তধন না থাকলে তো খুঁড়েও কিছু পাওয়া যাবে না।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযানটি আপাতত স্থগিত রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবো।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের কাছে এ ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সেসব যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তার করবে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আমরা পরামর্শ করছি। সব মিলিয়ে আরও দুই থেকে চারদিন সময় লাগবে। এরপর আমরা আবারও কাজ শুরু করবো।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের বিশেষজ্ঞরা জানান, যদি মাটির নিচে মেটাল জাতীয় কিছু থাকে, তবে স্ক্যান করলে সেটি বোঝা যাবে বা ধরা পড়বে। এটা একটি পদ্ধতি। আবার ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার (জিবিআর)’ দিয়ে মাটির ওপর থেকেও দেখা হয়। যদি নিচে কোনও কঠিন বস্তু থাকে, তবে ওই মেশিনে সেটার সংকেত দেবে। এটি আরেকটি পদ্ধতি। কাদামাটিতে এ যন্ত্রগুলো কম কার্যকর। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা হবে।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. রেশাদ মহম্মদ ইকরাম আলী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে তেমন কিছু নেই। তবে আমাদের কাছে একটি গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার (জিবিআর) ও স্ক্যানার আছে, সেটি দিয়ে মিরপুরের ওই বাড়িতে গুপ্তধন সন্ধানে কাজ করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এই স্ক্যানারটি ভেজা মাটিতে খুব একটা কার্যকর নয়।’
গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার (জিবিআর) ও স্ক্যানারের কার্যক্রম সম্পর্কে অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, এই স্ক্যানারটি ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন, সংযোগ তার, কোনও ফাটল শনাক্তকরণ, জনপথ ও রেলপথের গুণগত মান নির্ণয়, সেতুর ভিত্তি পরীক্ষা, বিপজ্জনক বর্জ্য মানচিত্রায়ন, ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণাধার শনাক্তকরণ, স্তরতাত্ত্বিক বিন্যাস নির্ণয়, ভূগর্ভস্থ ফাটল ও পানি শনাক্তকরণ, প্রত্নতত্ত্বগত ক্ষেত্রে সাইট মানচিত্রায়ন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শনাক্তকরণের মতো কাজে ব্যবহার করা হয়।
এই যন্ত্রটি কতদূর পর্যন্ত কাজ করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘এটি মেটাল ডিসটেন্স ও ওয়াটার কন্টেন্টের ওপর নির্ভর করবে। যদি শুকনো মাটি থাকে, তবে তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত এটি কাজ করবে। যদি এর মধ্যে ভেজা মাটি বা পনি থাকে তবে সেটি কাজ করবে না। কারণ, পানি থাকলে তা ভালো করে বোঝা যাবে না, সিগন্যাল বাধাগ্রস্ত হবে।’
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কতগুলো পদ্ধতি আছে যে ওপর থেকে ব্লাস্টের মাধ্যমে (বিস্ফোরণ) কম্পন তৈরি করে সেই কম্পনটি ভেতরে পাঠানো হয়। এতে যদি ওই কম্পনটি প্রতিফলিত হয়ে ফেরত আসে, তখন একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে বোঝা যায় কিছু আছে কিনা। তবে এই পদ্ধতিগুলো আমাদের দেশে করতে পারবে কিনা, সেটা আমার জানা নেই।’
.মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে গুপ্তধন সন্ধানের অভিযান সাময়িক স্থগিত রয়েছে। বৃষ্টি থামলে আবারও কার্যক্রম শুরু হবে। ’
উল্লেখ্য, গত ২১ জুলাই (শনিবার) রাজধানীর মিরপুর ১০-এর সি-ব্লকের ১৬ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িতে গুপ্তধনের খোঁজে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রশাসন ও পুলিশ। বাড়িটির নিচে কমপক্ষে দুই মণ স্বর্ণালংকার আছে; এমন দাবি ওঠায় এর সত্যতা নিশ্চিত করতে শুরু হয় এই অভিযান। বাড়ির ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় খোঁড়াখুঁড়ি স্থগিত রাখা হয়েছে। এরপর পুনরায় ২২ জুলাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
এর আগে গত ১০ জুলাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব নামের এক ব্যক্তি মিরপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ১২ জুলাই রাতে কয়েকজন লোক ওই বাড়ির ভেতরে গুপ্তধন আছে বলে জোরপূর্বক ঢোকার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে ১৪ জুলাই বাড়ির মালিক মুনিরুল ইসলাম থানায় জিডি করেন। পরে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বাড়িটিতে খননের সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।