ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের প্রশংসা করেছেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য, জঙ্গিবাদ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যেভাবে শেখ হাসিনা সাহসীকতা দেখিয়েছেন তা অতুলনীয়। কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন হাসিনা-মোদীর বিশ্বাসের সম্পর্ক ছাপিয়ে গেছে কূটনীতি, রাজনীতির হিসেবে নিকেশকেও। শুধু মোদী নয় বিশ্বের বিভিন্ন নেতারও শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখে তার প্রশংসা করেছেন। তাদের মধ্যে নরেদ্র মোদী অন্যমত।
মোদীর স্পষ্ট বার্তা, ভারত বাংলাদেশের উন্নয়ন একই সুতায় গাঁথা। তবে উন্নয়ন আর প্রগতির দৌঁড়ে থাকা বিশ্বে এখন অনেক বড় প্রশ্ন নিরাপত্তা আর শান্তি। নরেন্দ্র মোদী বলছেন, এখানেই শেখ হাসিনা সরকারে আস্থা ভারতের।
পারস্পারিক আস্থা এবং বিশ্বাসের এই মালা আরো দীর্ঘায়িত করার স্পষ্ট ঘোষণা নরেন্দ্র মোদীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা করা ভিশন দু হাজার একচল্লিশ বাস্তবায়নে সঙ্গে থাকারও ঘোষণা দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে ২০১৪ সালে ভারতে কংগ্রেসকে হটিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। সে সময় অনেকে মনে করেছিল, দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন হবে। আওয়ামী লীগের সব কিছুতেই বিজেপি সায় দেবে না। উল্লসিত বিএনপি নেতারা বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ উল্লাস করেছিল। লন্ডন থেকে তারেক জিয়া পাঠিয়েছিল অভিনন্দন বার্তা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোদি শেখ হাসিনার উপরই আস্থা রাখলেন। তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দিলেন।
ভারত চায় একটি সেক্যুলার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী দল আগামী নির্বাচনে জয়ী হোক। সেজন্য বিজেপি সরকারও বিএনপির উপর ভরসা করতে পারছে না, তা বিএনপি নেতাদের হতাশাতেই স্পষ্ট। বিএনপি যেভাবে জামায়ত ও জঙ্গিদের সাথে আতাত করে দেশকে অন্ধাকরে ঠেলে দিচ্ছে তাতেই মোদি সরকারের আস্থা হারিয়ে পেলেছেন তারা।
আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে দেশেকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখে মুগ্ধ মোদি সরকার। আর তাই শেখ হাসিনাতেই আস্থা রাখছেন তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন ভারত আওয়ামী লীগকে চায়? কেন তাঁরা এখনো আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে অস্বস্তি বোধ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কূটনীতিক এবং ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, এর ৮টি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলো হলো:
১. বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের জিরো টলারেন্স নীতি। বিভিন্ন আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে ভারতের বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতো। আর বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিল বাংলাদেশ। এখানে বিভিন্ন গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। ২০০৮ সালে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে, ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়। একারণেই এই অবস্থা অটুট রাখতে ভারত আওয়ামী লীগকে চায়।
২. ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে যে, বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আইএসআই ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবচেয়ে বড় মদদদাতা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার সঙ্গে উলফাসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগাযোগ আছে বলে ভারতের কাছে তথ্য আছে। বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপক মদদ দিয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র তার বড় উদাহরণ। এজন্য বিজেপি সরকার খাল কেটে কুমির আনতে চায় না।
৩. শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বের রোল মডেল- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর অন্তত তিনটি বক্তৃতায় এমন মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হলে তা ভারতের জন্যও বিপদের। বিএনপির সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে বলে ভারত মনে করে। এজন্য মোদির আস্থা শেখ হাসিনায়।
৪. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ১৯৭৫ এর পর থেকে খারাপ হতে থাকে। এক সময় এটা তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ককে সম্মানজনক সমঝোতার দিকে নিয়ে এসেছেন। অনেক অমীমাংসিত সমস্যা তিনি সৌহার্দের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় ভারত ছেদ চায় না। ট্রানজিটসহ দ্বিপাক্ষিক অনেক ইস্যুতে ভারত লাভবান হয়েছে। এই সুবিধাগুলোকে ভারত হুমকির মুখে ফেলতে চায়না।
৫. বাংলাদেশ- পাকিস্তান সম্পর্ক এখন স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ। এটা ভারতের জন্য খুবেই আনন্দের। অথচ বিএনপি এখনো পাকিস্তানমুখী।
৬. আওয়ামী লীগ পছন্দের একটি বড় কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি জাতির পিতার কন্যা। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজনীতিবিদদের কাছে খুবই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই কংগ্রেস, বিজেপি যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, শেখ হাসিনা আলাদা মর্যাদা সব সময়ই পান। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন, কথা ও কাজে তাঁর অসম্ভব মিল। এ কারণে শেখ হাসিনা ভারতে সম্মানের পাত্র।
৭. ভারতের অপছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই আছে তারেক জিয়া। ভারতে তারেক দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ হিসেবেই পরিচিত। ভারতের অভিযোগ, তারেকের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক রয়েছে। ভারত বহুবার তারেক জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। সর্বশেষে সুষমা স্বরাজও বেগম খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে ভাবতে বলেন। কিন্তু ভারত বুঝে গেছে তারেক জিয়াকে বিএনপি থেকে বাদ দেওয়া অসম্ভব।
৮. ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির প্রভাবশালী নেতার সবচেয়ে পছন্দের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে তিনি কূটনীতিও ভুলে যান। তার প্রকাশ্য শেখ হাসিনার প্রতি পক্ষপাত-ভারতের রাজনীতিতে কারও অজানা নয়।